মহাপবিত্র আল কোরান সমগ্র মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান রুপে মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থরূপে নাযিল করেছেন। মানব জীবনের ইহকালীন ও পরলৌকিক যাবতীয় কল্যাণ এতে বিধৃত হয়েছে। দৈনন্দিন আমলের মধ্যে দোয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হচ্ছে -
وقال ربكم ادعونى استجب لكم ان الذين يستكبرون عن عبادتى سيدخلون جهنم داخرين - (আল মুমিন-৬০)
অর্থ : তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সারা দিব। যারা অহংকারে আমার উপাসনা বিমুখ, ওরা লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে মাআরেফুল কোরানে বলা হয়েছে, দোয়ার শাব্দিক অর্থ ডাকা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন প্রয়োজনে ডাকার অর্থে ব্যবহৃত হয়। কখনও যিকিরকেও দোয়া বলা হয়। উম্মতে মোহাম্মাদীয়ার বিশেষ সম্মানের কারণে এই আয়াতে তাদেরকে দোয়া করার আদেশ করা হয়েছে এবং তা কবুল করার ওয়াদা করা হয়েছে। যারা দোয়া করে না, তাদের জন্য শাস্তিবানী উচ্চারণ করা হয়েছে।
কাবে আহবার (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, পূর্ব যুগে কেবল নবীগণকেই বলা হত, দোয়া করুন; আমি কবুল করব। এখন এই আদেশ সকলের জন্য ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে এবং উম্মতে মোহাম্মাদিরই বৈশিষ্টি।
আলোচ্য আয়াতে দোয়া অর্থে ইবাদত বর্জনকারীকে জাহান্নামের শাস্তি বানী শোনানো হয়েছে। যদি সে অহংকার বশতঃ বর্জন করে। কেননা অহংকার বশতঃ দোয়া বর্জন করা কুফরের লক্ষন। তাই সে জাহান্নামের যোগ্য হয়ে যায়। নতুবা সাধারণ দোয়া ফরজ বা ওয়াজিব নয়। দোয়া না করলে গোনাহ হয় না। তবে দোয়া করা সমস্ত আলেমের মতে মোস্তাহাব ও উত্তম। এবং হাদীস অনুযায়ী বরকত লাভের কারণ।(সংক্ষিপ্ত তাফসিরে মাআরেফুল কোরান; পৃ: ১১৯৩)
সকাল সন্ধ্যায় জিকির প্রসংঙ্গে পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে,
يا ايها الذين آمنوا اكروا الله ذكرا كثيرا ، وسبحوه بكرة واصيلا. (احزاب
অর্থ : হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
(আহযাব-৪১)
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা জিকির ব্যতীত এমন কোন ফরজই আরোপ করেননি যার পরিসীমা ও পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। নামাজ দিনে পাঁচবার এবং প্রত্যেক নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট। রমজানের রোজা নির্দিষ্টকালের জন্য। হজ্বও বিশেষ স্থানে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি ও সুনির্দিষ্ট কর্ম-ক্রিয়ার নাম। যাকাতও বছরে একবারই ফরজ হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর জিকির এমন এবাদত, যার কোন সীমা বা সংখ্যা নির্ধারিত নেই। বিশেষ সময়কালও নির্ধারিত নেই অথবা এর জন্য দাঁড়ানো বা বসার কোন বিশেষ অবস্থাও নির্ধারিত নেই। এমনকি পবিত্র এবং অযু সহ থাকারও কোন শর্ত আরোপ করা হয়নি। সফরে থাকুক বা বাড়ীতে অবস্থান করুক, সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ, স্থলভাগ হোক বা জলভাগ, রাত হোক বা দিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরের হুকুম রয়েছে। (মাআরেফুল কোরান)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
فاصبر ان وعد الله حق و استغفر لذنبك و سبح بحمد ربك بالعشى و الابكار. (المؤمن
অর্থ : অতএব, আপনি সবর করুন। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আপনি আপনার গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করুন এবং সকাল-সন্ধ্যায় আপনার পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করুন।
(মুমিন-৫৫)
আরো ইরশাদ হয়েছে,
يسبحون الليل و النهار ولا يفترون . (الانبياء
অর্থ : তারা (ফেরেশতারা) রাতদিন তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা শৈথিল্য করে না
(আম্বিয়া-২০)
অন্যত্র মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
فاصبر على ما يقولون و سبح بحمد ربك قبل طلوع الشمس وقبل غروبها ومن آناء الليل فسبح و اطراف النهار لعلك ترضى . (طه) অর্থ : সুতরাং এরা যা বলে সে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করুন। এবং আপনার পালনকর্তার সুপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং তাসবীহ পাঠ করুন রাতের কিছু অংশে এবং দিবা ভাগে; সম্ভবত তাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।
হাদিসের আলোকে জিকির দোয়ার গুরুত্ব : হজরত জাবির ইবনে সামুরাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا صلى الفجر قعد فى مصلاه حتى تطلع الشمس . مسلم
অর্থ : নবি (সা.) ফজরের সালাত আদায়ের পর সূর্য উঠা পর্যন্ত নিজের সালাতের জায়গায় বসে থাকতেন (এবং তাসবিহ- জিকিরে রত থাকতেন)।
(মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে এসেছে
عن ابى موسى الاشعرى رضى الله عنه قال : قال النبى صلى الله عليه وسلم : مثل المؤمن الذى يذكر ربه والذى لا يذكر ربه مثال الحي والميت رواه البخارى و رواه مسلم ، فقال : مثل البيت الذى يذكر الله فيه والبيت الذى لا يذكر الله فيه مثل الحي والميت.
অর্থ : হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে আর যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে জীবিত ও মৃতের ন্যায়।
(বুখারি)
মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, অতপর তিনি বলেছেন, যে ঘরে আল্লাহর জিকির হয় আর যে ঘরে আল্লাহর জিকির হয় না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের সমতুল্য।(মুসলিম)
রাসুল (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ان الدعاء هو العبادة
হাদিস বিশারদগণ বলেন, ان الدعاء هو العبادة বাক্যের অর্থ এরুপ হতে পারে যে, প্রত্যেক ইবাদাতই দুআ। এখানে অর্থ এই যে, শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে দোয়া ও ইবাদাত যতিও পৃথক পৃথক। কিন্তু উভয়ের ভাবর্থ এক। অর্থাৎ প্রত্যেক দোয়াই এবাদত এবং প্রত্যেক ইবাদতই দোয়া। কারণ এই যে, দোয়া বলা হয় কারো সামনে চুড়ান্ত দীনতা অবলম্বন করাকে। বলা বাহুল্য, নিজেকে কারও মুখাপেক্ষী মনে করে তার সামনে সওয়ালের হাত প্রসারিত করা বড় দীনতা, যা এবাদাতের অর্থ । এমনি ভাবে প্রত্যেক এবাদাতের সারমর্মও আল্লাহর কাছে মাগফেরাত ও জান্নাত তলব করা এবং ইহকাল ও পরকালের নিরাপত্তা প্রার্থনা করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে দোয়া অপেক্ষা অধিক সম্মানিত কোন কিছুই নাই। (তিরমিজি)
তিনি আরও বলেন,
الدعاء مخ العبادة
অর্থ : দোয়া এবাদতের মগজ।
(তিরমিজি)
আরও বর্ণিত হয়েছে,
من لم يسئل الله يغضب عليه (ترمذى)
অর্থ : যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে চায় না (দোয়া করে না) আল্লাহ তায়ালা তার উপর রাগান্বিত হন।
আরও বর্ণিত হয়েছে,
من سره ان يستجيب الله له عند الشدائد و الكرب فليكثر الدعاء فى الرخاء . ترمذى
অর্থ : যে ব্যক্তি চায় যে, বিপদের সময় তার দোয়া কবুল হোক, তাহলে সে যেন সুখে দুখে সর্বাবস্থায় বেশি বেশি দোয়া করে।
(তিরমিজি)
অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে দোয়া ও জিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সর্বাবস্থায় দোয়া করে পূর্ন রহমত ও বরকত অর্জন করার তৌফিক দান করুন।
আমিন...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন